শুনেছিস? তরুণ আত্মহত্যা করেছে!

২৫ জানুয়ারি ২০১৭ সাল:
রুমের প্রায় সবাই একটি ছেলের সাথে মজা করত। ছেলেটির গায়ের রঙ কালো। দেহের গড়ন ছোট, যেন অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া কোন বালক। চেহারায় অসহায়, অযত্ন আর দারিদ্র্যতার ছাপ। ছেলেটি তার মেধার জোরে দেশের সর্বচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ ইউনিটে ১৯৯তম হয়। বাণিজ্য অনুষদের সেরা বিষয়ে ভর্তি হয় সে।

ছেলেটি সবার থেকে আলাদা। সবাই যেখানে আনন্দে আত্মহারা, আড্ডায় মাতোয়ারা, ছেলেটি সেখানে একেবারেই চুপচাপ। ছেলেটির নানা দুর্বলতা নিয়ে নানা ভাবে সবাই থাকে ক্ষ্যাপাত। তবুও ছেলেটি ভাবলেশহীন। অসহায় গলায় ছেলেটির উত্তর, “আমি দুর্বল বলে, তোরা আমার সাথে এমন করিছ...”

এমনি ভাবেই চলছিল সব। একদিন লক্ষ করলাম,  কোন কান্নার শব্দ নেই, ছেলেটি চোখের পানি মুছছে। তখন কেউ তাকে ক্ষ্যাপায়নি বা মজাও করেনি। তবে সে গোপনে কাঁদছে কেন?কারণ জানার চেষ্টা করলাম। জানলাম, ছেলেটির মা নেই, সপ্তম শ্রেণিতে থাকতেই মা মারা গেছে। তার জীবনে কোন ভালবাসা নেই, কোন আদর নেই, কোন যত্ন নেই। না খেয়ে থাকলেও তাকে কেউ জিজ্ঞেস করে না, “বাবা খেয়েছিস?”...

"কিছু মানুষের জীবনে
কখনো কোথাও ভালবাসা জোটে না"
গণরুমে 'তরুণ' (তরুণ হোসেন) ছিল সবচেয়ে নিরহ একটি ছেলে। শৈশবে মা হারা অযত্নে বড় হওয়া এই ছেলেটি ২০১৫-১৬ সেশনে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্সে বিভাগে।

অর্থিক সংকটে জর্জরিত ছেলিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নানা কারণে চরম হতাশায় ভুগতে শুরু করে। তার শারীরিক গঠন ও দেহের কালো রঙের কারণে অনেকের কাছেই সে যেন একটু বেশিই নিগৃহীত হত। কিন্তু আমি জানতাম ছেলেটা কতটা মেধাবি, কতটা সংগ্রামী। এর আগে আমি তার দুঃখ-সংগ্রাম নিয়ে পোষ্টও দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, 'সফল হলে তোকে নিয়ে একটা ফিচার করবো।'

গতকালও সবাই যখন তার একটি পুরানো ছবিতে হা হা রিঅ্যাক্ট দিচ্ছিল, আমি তখন কমেন্টে লিখেছিলাম 'মেধাবী ছেলের মুখ'। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পরে তরুণ আমাকে অনেক অনুরোধ করেছিল, আমি যেন ওকে ভিসি স্যারের কাছে নিয়ে যাই এবং ওর সাবজেক্ট চেঞ্জ করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করি! আমি হেসে বলেছিলাম, 'মানুষ ফিনান্স পায় না আর তুই পড়বি না! তাও আবার ২য় বর্ষে উঠে!'

আসলে মানসিক কষ্ট, অর্থিক সংকট আর ডিপার্টমেন্টের চাপ সব একসাথে না নিতে পেরে এই অনুরোধ করেছিল। পরে জেনেছিলাম ও নিজে নিজেই বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন শিবলি রুবাইয়াতুল স্যারের কাছে গিয়েছিল। স্যারও ওকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন।

এই ক্যাম্পাসের প্রায় সবাই ভালবাসতে চায়, প্রেমে পড়তে চায়। তরুণও বেসেছিল। কিন্তু চারপাশের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতা তার নিজেকে প্রকাশ করার শক্তি কেড়ে নিয়েছিল। বাজে সিজিপিএ, বাজে চেহারা, কে তাকে ভালবাসবে? এই ক্যাম্পসে শত নাল, নীল রঙিন বাতি জ্বলে, বাহারি পোশাকের সাজে প্রিয়জনের হাতে টিএসসিতে সন্ধ্যা নামে। কিন্তু তরুণদের জীবনে কোন ভালবাসা মেলে না, সব মহল থেকে ফিরতে হয় মলিন মুখে নিচু মাথায়।

আজ (১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) সন্ধ্যায় হঠাৎ বন্ধু মেহেদি হাসান রূপমের কল এল - 'শুনেছিস? তরুণ আত্মহত্যা করেছে।'

তার মৃত্যুতে ঢাবি শিক্ষার্থীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

©সংগৃহীত

Comments

Popular posts from this blog

CGPA, CREDIT & WGPA গণনা পদ্ধতি

আন যুক্ত ঢাবিয়ান নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরামর্শ। MasterPiece University Admission Coaching