মানবতা পৃথিবীর বুকে এমনিভাবে বেঁচে থাকুক যুগ-যুগান্তর ধরে।

প্রমা (ছদ্মনাম), সদ্য ভর্তি হওয়া ঢাবির প্রথম বর্ষের বাংলা বিভাগের ছাত্রী,আমি তাকে শুধু ছাত্রী বলবো না,সে আমার নিজ চোখে দেখা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মহীয়ষী নারী। তার কাহিনীই আজ আপনাদেরকে বলবো।

আমি একটু অসুস্থ,ক্লাস করতে একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না,স্যারকে বলে হলে চলে যাবো,কবি সুফিয়া কামাল হল। বাংলা একাডেমীতে কম্পিউটার কোর্স করতে চাচ্ছি,ভর্তির খোজ নিতে হেটে হেটেই বাংলা একাডেমী পর্যন্ত গেলাম। ঐখানে কাজ শেষ করে হলের দিকে হাটা ধরলাম। কয়েক কদম সামনে গিয়ে একটু অবাক হলাম!! দেখি যে রাস্তায় পরে থাকা এক বৃদ্ধা,অসুস্থ মহিলার মুখে একটি মেয়ে খাবার তুলে দিচ্ছে। আর তার চারপাশে কিছুলোক জটলা বেধে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে দেখে কিন্ঞ্চিৎ অবাক হলাম! এমন মর্ডাণ একটা মেয়ে এমন রাস্তায় নোংরা অবস্থায় পরে থাকা মহিলার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে!! ভবলাম যে,হয়তো মহিলা খাবার চাইছে তাই খাবার দিচ্ছে। এই ভেবে হলের দিকে পা বাড়াতে লাগলাম। কিন্তু কি ভেবে যেন ২/৩ কদম সামনে গিয়ে আবার পিছনে ব্যাক করলাম। কিছুক্ষণ দাড়ালাম,আসলে কি ঘটছে তা বুঝার চেষ্টা করছি। ভাবলাম,দাড়িয়েইতো আছি,কয়েকটা পিক তুলি। আমার ফোনের ক্যামেরা ওর দিকে দেখতে পেয়ে ও ভাবলো যে আমি ভিডিও করছি। সে বললো,"আপনি ভিডিও করবেন না প্লিজ"। উত্তর দিলাম,"আমি ভিডিও করছি না আপু"(যদিও কয়েকটা ক্লিক দেওয়া অলরেডি শেষ)। ফোনটা ব্যাগে রেখে দিলাম।

রাস্তায় মুমূর্ষু অবস্থায় পরে থাকা মহিলাটির হাত দুটি মির্কি রোগীর (আঞ্চলিক ভাষা) মতো অনবরত কাঁপছিলো,গায়ে রক্ত বা মাংশ বলতে কোনো অংশ নেই,শুধু হাড়টুকুই অবশিষ্ট। তার গায়ের গন্ধে রাস্তায় হেঁটে চলা মানুষগুলো নাকে কাপড় দিচ্ছিলো। মহিলাটি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলো,"আমি হাসপাতাল যামু,আমারে হাসপাতাল নিয়া যাও কেউ।হাসপাতাল নিয়া যাও,হাসপাতাল যামু"। তার হাসপাতাল যাওয়ার এই আর্তনাত শুনে নিজেকে আর আশেপাশের মানুষগুলোকে মানুষ মনে হচ্ছিলো না। ভাবলাম,আমাদের জায়গায় একটা পশু থাকলেও সে এই অসহায় মানুষটিকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো। হায়রে মানুষ!!!

প্রমা মহিলাটিকে হসপিটাল নেওয়ার ইচ্ছা করছে।  বাট তার কাছে হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার মতো তেমন টাকা নেই,আর সেই কারণে সে আফসোসও করছিলো যে, ইশ্!আগে জানলে বাসা থেকে টাকা নিয়ে বের হতাম। এইবার আমার মনেও দাগ কাটলো। ওর টাকা নেই বলে ও আফসোস করছে,অথচ আমি ব্যাগে  টাকা রেখেও বোবার মতো দাড়িয়ে আছি! ছি!!!

এবার নিজেকে মানুষ ভাবতে শুরু করলাম। প্রমাকে বল্লাম,চলো আমরা দুজন মিলে উনাকে হসপিটাল নিয়ে যাই। সে সহমত পোষণ করলো।

বাট কিভাবে, কোন হাসপাতাল নিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। প্রমা তার এক ছেলে ফ্রেন্ডকে ফোন দিলো।  আমিও আমার ফ্রেন্ডদের ফোন দিলাম, বাট তারা ক্লাসে থাকার কারণে রেসপন্স করতে পারেনি। প্রমার ফ্রেন্ড সাথে সাথেই চলে আসলো। এতে করে আমরাও আরো ভরসা পেলাম। তার নাম  তামিম(ছদ্মনাম),সেও ঢাবির। ছাত্র,মার্কেটিং ১ম বর্ষ। আরেকটা কথা যা না বল্লে স্বার্থপরের লিস্টে নাম লিখাতে হবে,তা হলো সোহরাওয়ার্দীর এক পাগলটাইপ লোক এই কাজে আমাদেরকে অত্যন্ত সহযোগীতা করেছিলো।

আমরা মহিলাটিকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। সবাই ভাবতেছি যে উনার(মহিলা) যা অবস্থা তাতে উনাকে রিক্সা দিয়ে নিয়ে যাওয়া পসিবল না। ভ্যান হলে ভালো হতো,তাও পাচ্ছি না। তখন সিএনজি ডাকা হলো,আমি আর প্রমা কোনোরকমে কষ্ট করে উনাকে সিএনজিতে উঠালাম। সিএনজিতে উনাকে শুয়িয়ে বসার আর কোনো জায়গা নেই। আমরা ভাবনায় পরে গেলাম যে উনাকে ধরে না রাখলে তো উনি সিট থেকে পরে গিয়ে ব্যাথা পাবে। তখন পাগলটাইপ লোকটি বল্লো যে আমি উনাকে ধরতেছি,আপনারা কোনো চিন্তা কইরেন না। তখন ঐ লোকটিকে আমরা রিক্সা করে ঢামেক এ গেলাম।

টিকেট কাটা,ভর্তি করানো,ঔষধপত্র কেনাসহ সকল কাজই প্রমার ফ্রেন্ড তামিম করেছে।

একটা মানুষকে হসপিটাল ভর্তি করানোটাওতো চারটিখানি কথা না। বিছানা,কম্বল,বেডশিট,বালিশ,জামা-কাপড়,ঔষধ-পত্র আরো কতোকিছুইতো দরকার। ঐদিকে ডাক্তার ডাকা,নার্স ডাকা,উনাকে ফ্রেশ করানোর জন্য খালাদেরকে ডাকা,আরোকতকি।
আমরা অতিপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ও কিছু খাবার কিনে উনাকে দিয়ে আসলাম। যেকোনো খাবার মুখে তুলে দিতেই এমনভাবে উনি এমন পাগল পাগল হয়ে খাচ্ছে যে আপনি তা দেখে সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে কতোদিন আগে মুখে দানা-পানি পরেছিলো।

যাই হোক,উনাকে ভর্তি করানো হলো। ভাবনায় পরলাম,আমরাতো আর সারাক্ষণ উনার পাশে থাকতে পারবো না,তাহলে উনার দেখাশোনা কে করবে??? আবারো কিছুটা আশ্চর্য হলাম, পাগলটাইপ লোকটি নিজ থেকেই উনার দেখা-শোনা করার দায়িত্ব নিচ্ছেন। বলতেছেন যে,"আফনেরা কইলে আমি দেখমু,কোনো চিন্তা কইরেন না"। আমরা লোকটির উপর কিছুটা ভরসা করলাম। হসপিটাল থেকে বের হবার আগে মোর্শেদ ভাইকে (ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই ও CEP- Change the Earth for People এর পরিচালক,যিনি তার এই বয়সের মধ্যে অসংখ্য,অগুণীত রুগীকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন+ মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন)
ফোন দিয়ে তাকে  ঘটনাটি জানালাম। ভাইয়াও সাথে সাথেই হসপিটাল হাজির। তারপর থেকে রোগীর যতোকিছু দরকার,ডাক্তার-নার্সদের সাথে কথা বলা সবকিছুই ভাইয়া এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছেন। রোগীও আলহামদুলিল্লাহ এখন কিছুটা ভালো।

(ঘটনাটি ৩০ শে জানুয়ারীতে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা)

(প্রথমে নিজেকে স্কিপ করে ঘটনাটি লিখার চেষ্টা করেছিলাম,বাট এতে করে কাহিনী হচ্ছে না। আমি তেমন কিছুই করিনি,সবকিছু ভালোটাই প্রমা মেয়েটার কারণে হয়েছে,যে আমার জীবনের দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবী।)

মহান আল্লাহপাকের নিকট অশেষ শুকরিয়া যে আমাদের সহযোগীতার ওসিলায় একজন অসহায় মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে,একটু আরাম ও শান্তি পাচ্ছে,কিছু খেয়ে জীবন-ধারণ করতে পারছে,আলহামদুলিল্লাহ। এটাইতো জীবনের অনেক বড় পাওয়া।)

(ছবি নং ১ ও ২: রোগীর পূর্ব অবস্থা,
ছবি নং ৩: বর্তমান অবস্থা)

প্রমা,তামিম ও মোর্শেদ ভাইয়ার মতো অসংখ্য স্টুডেন্ট ঢাবিতে রয়েছে। যারা নিজের চিন্তা করে না,পাশের মানুষটিকে ভালো রাখার চিন্তাটাই করে। খালিচোখে দেখলে দিনশেষে তাদের পাওয়া শূণ্য। বাট অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচন করলে দেখতে পাবেন,দিনশেষে তারাই শ্রেষ্ঠ মানব,সৃষ্টিকর্তার প্রিয় বান্দা। প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে ভালোবাসলেইতো সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসা পাওয়া যায়। আর "সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসা"-সেতো জীবনের  সকলপাওয়ার উর্ধ্বে।

মানবতা পৃথিবীর বুকে এমনিভাবে বেঁচে থাকুক যুগ-যুগান্তর ধরে।

©Swarna Moni,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার থেকে সংগৃহীত।

Comments

Popular posts from this blog

CGPA, CREDIT & WGPA গণনা পদ্ধতি

আন যুক্ত ঢাবিয়ান নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরামর্শ। MasterPiece University Admission Coaching